
মঙ্গলবার ● ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » আইসিটি জার্নাল » বাংলাদেশে খাদ্য সংরক্ষণে UV-C প্রযুক্তি: এক বৈপ্লবিক সম্ভাবনা
বাংলাদেশে খাদ্য সংরক্ষণে UV-C প্রযুক্তি: এক বৈপ্লবিক সম্ভাবনা
ভূমিকা:
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০৬ লক্ষ টন খাদ্য অপচয় হয়, যার আর্থিক মূল্য অত্যন্ত বেশি। FAO (Food and Agriculture Organization)-এর তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপাদন অপচয় হয়। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তার জন্যই নয়, পরিবেশের জন্যও একটি গুরুতর হুমকি।
এছাড়া, গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে প্রায় ৫০ কেজি খাদ্য অপচয় করে থাকে, যা সরাসরি খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তাই খাদ্য অপচয় কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যের বড় অংশই পচনশীল, যা অনুজীবজনিত কারণে নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, অতি বেগুনি রশ্মি (UV-C) প্রযুক্তি খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।
SDG লক্ষ্য ও খাদ্য অপচয় কমানো:
বাংলাদেশ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার অন্যতম লক্ষ্য হলো “খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও খাদ্য অপচয় হ্রাস।” বিশেষ করে SDG Goal 12-এর আওতায় খাদ্য অপচয় কমানোর জন্য UV-C প্রযুক্তি একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি খাদ্য অপচয় হ্রাস করার পাশাপাশি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচও কমাতে সক্ষম।
UV-C প্রযুক্তি কী এবং কিভাবে কাজ করে:
UV-C (অতি বেগুনি রশ্মি) ২০০-২৮০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্যে থাকে, যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক এবং অন্যান্য মাইক্রোব ধ্বংস করতে সক্ষম। খাদ্যের উপর UV-C রশ্মি প্রয়োগ করলে এটি জীবাণুর DNA বা RNA নষ্ট করে দেয়, ফলে তারা বংশবিস্তার করতে পারে না এবং ধীরে ধীরে মারা যায়। এর মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় থাকে, পাশাপাশি খাদ্য দীর্ঘদিন নিরাপদ ও তাজা থাকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, UV-C প্রযুক্তি ব্যবহার করলে খাদ্যে জীবাণুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, এক গবেষণায় দেখা গেছে Salmonella এবং Listeria monocytogenes ব্যাকটেরিয়া UV-C রশ্মির মাধ্যমে ৪.৪-লগ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব।
UV-C প্রযুক্তির প্রয়োগপদ্ধতি ও ডোজ:
সঠিক ডোজ নির্ধারণ UV-C প্রযুক্তির কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত:
* ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য প্রয়োজন ২০০-৪০০ জুল/বর্গমিটার
* ভাইরাস নিষ্ক্রিয়করণের জন্য প্রয়োজন ৪০০-৬০০ জুল/বর্গমিটার
* ছত্রাক ও বীজাণু ধ্বংসের জন্য প্রয়োজন ৬০০-১০০০ জুল/বর্গমিটার
প্রয়োগকাল সাধারণত ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট, তবে খাদ্যপণ্যের ধরন ও প্রকৃতির উপর এটি ভিন্ন হতে পারে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে UV-C প্রযুক্তির ব্যবহার:
বাংলাদেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে UV-C প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক সম্ভাবনাময়। বিশেষত ফলের রস, দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস, মাছ ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে এটি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। UV-C রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে পণ্যের শেলফ লাইফ বাড়ানো, জীবাণু কমানো এবং খরচ হ্রাস করা সম্ভব।
১. ফলমূল ও শাকসবজি: UV-C প্রযুক্তি প্রয়োগে টমেটো, লাল শাকসহ বিভিন্ন শাকসবজি ৫-৭ দিন পর্যন্ত বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায়, গুণগত মান অক্ষুণ্ণ থাকে।
২. দুগ্ধজাত পণ্য: দুধ ও দইয়ের শেলফ লাইফ বাড়াতে UV-C প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। এটি দুধে উপস্থিত ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া যেমন লিস্টেরিয়া ও সালমোনেলা ধ্বংস করতে সক্ষম।
৩. মাংস ও মাছ: মাংস ও মাছের মধ্যে জীবাণু কমাতে UV-C সাহায্য করে, ফলে এগুলো দীর্ঘ সময় নিরাপদে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
কৃষিপণ্যের অপচয় হ্রাস:
বাংলাদেশে কৃষিপণ্য যেমন ফল, শাকসবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদির অপচয় UV-C প্রযুক্তির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। এটি জীবাণু ধ্বংস করে খাদ্যের শেলফ লাইফ বৃদ্ধি করে, ফলে কৃষকরা ভালো দাম পান এবং খাদ্য নিরাপত্তা আরও সুসংহত হয়।
UV-C প্রযুক্তির বাস্তবায়ন:
১. প্রাথমিক বিনিয়োগ: প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু খরচ বেশি হতে পারে। তবে সরকারী সহায়তা, ভর্তুকি এবং সাশ্রয়ী সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে এটি সহজলভ্য করা সম্ভব।
২. প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা: কৃষক ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প সংশ্লিষ্টদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন জরুরি। একইসাথে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে UV-C প্রযুক্তির উপকারিতা প্রচার করতে হবে।
৩. গবেষণা ও উন্নয়ন: বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পক্ষেত্রে UV-C প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে সঠিক প্রয়োগ এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
সরকারি, বেসরকারি, NGO ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা:
সরকার: প্রাথমিক বিনিয়োগে সহায়তা, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং জাতীয় নীতি প্রণয়ন।
বেসরকারি খাত: খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষি-পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় UV-C প্রযুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন।
NGO: স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা।
বিশ্ববিদ্যালয়: খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি গবেষণায় UV-C প্রযুক্তি নিয়ে নতুন উদ্যোগ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা।
উপসংহার:
অতি বেগুনি রশ্মি (UV-C) প্রযুক্তি বাংলাদেশের খাদ্য সংরক্ষণে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্য অপচয় রোধ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আর্থিক ক্ষতি কমানো সম্ভব। সবুজ প্রযুক্তির অংশ হিসেবে সরকার, বেসরকারি খাত, NGO এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমেই UV-C প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
-মোক্তাদিরুল আলম ডলার
এমএসসি ইন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং (সাংহাই ওশেন ইউনিভার্সিটি)
UV এবং ইনফ্রারেড টেকনোলজি স্পেশালিস্ট (সাংহাই সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)